বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

মানব সভ্যতার কলঙ্ক লিটলবয়: মিনিটেই প্রাণ হারায় ৭০ হাজার মানুষ

 

৬ আগস্ট ১৯৪৫ সাল। সকাল ৮টা ৪৪মিনিট। ঘুম থেকে উঠে যার যার মত কর্মব্যস্ততায় নেমে পড়ে হিরোসীমা শহরের বাসিন্দারা। সকলেই যার যার মত ব্যস্ত। কেউ ব্যস্ত ঘরে কাজ নিয়ে কেউবা ব্যস্ত সকালের নাস্তায়। কেউ নিত্যপ্রয়োজনীয় পন্য সামগ্রী ক্রয়ে ব্যস্ত। কেউ প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন অফিসে যাওয়ার। কেউবা রয়েছেন রাস্তায়। কেউ কেউ তখনো ঘুমিয়েছিলেন বিলাসি ঘুমে। আর এর মধ্যেই ঘটে যায় মানব সভ্যতার ইতিহাসের কলঙ্কময় ঘটনা।

এরই মধ্যে জাপানের পিনিয়ন দ্বীপ থেকে কর্নেল পল ডব্লু টিবেটস হিরোশিমা শহর ধ্বংসের উদ্দেশ্য প্রশান্ত মহাসাগরের উপর দিয়ে প্রায় পাঁচ ঘন্টা একত্রিশ মিনিট আকাশের বুকে উড়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে যায় একটি B-20 বিমান নাম ইনোলা গে। সাথে নিয়ে যায় নামক ৪৪০০ কেজি ওজনবিশিষ্ট একটি শক্তিশালী পরমাণু বোমা। যার নাম ‘লিটলবয়’।

ইনোলা গে বি-২৯ এয়ারক্রাফট ও বিমানে ক্রুরা। ছবি: GETTY IMAGES

সকাল ৮টা ১৮ মিনিট ৪৪ সেকেন্ডে প্রায় ২৫হাজার ফুট উপর থেকে কর্মব্যস্ততাময় হিরোশিমা শহরের উপর নিক্ষেপ করা হয় মানব সভ্যতা বিধ্বংসী এই মরণাস্ত্র।  ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৯০০ফুট উপরে বিস্ফোরিত হলো লিটল বয়।মুহুর্তের মধ্যে ব্যাঙের ছাতার মতো আগুনের ঝলকা ঝরে পড়ল ৩ লাখ ৪০ হাজার মানুষের হিরোশিমা শহরে। আর সাথে সাথে মৃত্যু হল প্রায় সত্তর হাজার মানুষের। কয়েক ঘন্টার মধ্যে মৃত্যু মিছিল ভারি হয়। সংখ্যা দাড়ায় প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজারে। কিন্তু পরমাণু বোমার তেজস্ক্রিয়তার শিকার হয়ে পরবর্তী সপ্তাহ, মাস এবং বছরগুলিতে আরও বহু মানুষ মারা গিয়েছিল। (তথ্যসূত্র)

লিটল বয় হচ্ছে একটি পারমাণবিক অস্ত্রের সাংকেতিক নাম। মানব ইতিহাসে প্রথম কোন পারমাণবিক বোমার প্রয়োগ করেছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুদ্ধ, প্রতিহিংসা ও পার্লহারবার আক্রমণের প্রতিশোধ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই অস্ত্রের প্রয়োগ করেছিলো। যা ছিলো তেজস্ক্রিয় পরমাণু: ইউরেনিয়াম-২৩৫ দিয়ে তৈরী এবং প্রায় ৪৪০০ কেজি ওজনের একটি মরণাস্ত্র। এটির দৈর্ঘ্য ৯.৮৪ফুট এবং পরিধি :২৮ ইঞ্চি। B29 সুপারফোর্টস যুদ্ধ বিমানে পাইলট কর্নেল পল টিবেটস এর নিক্ষেপ করেন। এটি পতনের সময় বিস্ফোরণের মাত্রা ছিলো প্রায় ১৩ কিলোটন TNT -এর সমতুল্য। (তথ্যসূত্র)

ম্যানহাটন প্রোজেক্টের তিনটি পারমাণবিক বোমার নামকরণ করেছিলেন লস এলমস ল্যাবরেটরির প্রাক্তন শিক্ষার্থী রবার্ট সারবার। এগুলোর আকৃতির কারণে তিনি এই নামকরণ করেছিলেন। ১৯৪৫ সালের ৬ই আগস্ট সকালে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী জাপানের হিরোশিমা শহরের ওপর লিটল বয় নামের নিউক্লীয় বোমা ফেলে এবং এর তিন দিন পর নাগাসাকি শহরের ওপর ফ্যাট ম্যান নামের আরেকটি নিউক্লীয় বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।

হামলায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া হিরোশিমা শহর। ছবি: GETTY IMAGES

মার্কিন বাহিনী জাপানের হিরোশিমা শহরে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম পারমাণবিক বোমা লিটলবয় নিক্ষেপ করে। এর আঘাতে মাটির সঙ্গে মিশে যায় শহরে ৬০ শতাংশ দালান-কোঠা। ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয় একটি নগরী। লিটলবয় নিক্ষেপের ৩দিন পর জাপানের আরেক শহর নাগাসাকিতে আরেটি পারমানবিক হামলা চালায় মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্র। যার নাম দেয়া হয়েছিলো ফ্যাটম্যান।

মাটির সাথে মিশে গিয়েছিলো শহরের ৬০ শতাংশ ঘর-বাড়ি। ছবি: GETTY IMAGES

১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্টের এ ধ্বংস লীলায় শিকার হওয়া মানুষরা জাপানে ‘হিবাকুশা’ নামে পরিচিত। একটা সময় ছিল যখন জাপানিরা হিবাকুশা’র দুঃখ আর বেদনার কথা প্রকাশ করতে দ্বিধাবোধ করত। বিশ্বের অনেক দেশের লোকজনই আণবিক বোমা হামলায় যারা সরাসরি শিকার হয়েছেন তাঁদের মুখ থেকে মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা শুনে মর্মাহত হন।  এই দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া এক স্কুলছাত্রী জিঙ্কওক্লাইন। এই ঘটনার ১২ বছর পর ১৯৫৭খ্রিস্টাব্দে বিবিসি (BBC) এর কাছে তার দেখা সেই বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে। তার বর্ণনা ছিল এই রূপ-

কয়েক গজ দূরে আমারি স্কুলের একটি মেয়ে হাত নাড়াতে নাড়াতে আমার দিকে ছুটে আসছিল। ঠিক তখন আমি আমার চোখের পাতার নিচে এক অতি উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি অনুভব করলাম।সাথে সাথে শুনতে পেলাম এক বিকট শব্দ সঙ্গে সঙ্গে একটা প্রচন্ড ঝাপটা আমাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল। আমি কয়েক মুহুর্তের জন্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম।

কিন্তু চেতনা ফিরে আসার পর আমি দেখলাম আমার চারপাশে শুধু অন্ধকার আর শুনতে পেলাম মানুষের আত্মচিৎকার তখন আমি বুঝতে পারলাম যে আমি ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছি। তখন আমিও চিৎকার শুরু করলাম।

হঠাৎ দেখতে পেলাম দুটো সবল হাত আমাকে বের করার চেষ্টা করছে।আমিও আঁকড়ে ধরলাম। আমাকে বাইরে বের করে আনা হলো। আমি অনুভব করলাম পেছনে আগুন।আমি হুমড়ি খেতে খেতে ধ্বংস স্তূপের উপর দিয়ে ছুটতে লাগলাম পাহাড়ের দিকে। সেখানে আমি আর দাঁড়াতে পারছিলাম না। লুটিয়ে পড়লাম মাটিতে যখন আমি জ্ঞান ফিরে পাই তখন মাঝরাত্রি। চোখ মেলে দেখি হিরোশিমা শহর জ্বলছে।এরপর আমি প্রথমবার আমার বাবা,মা কেমন আছে ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম তারপর যদিও বিকেলে দিকে আমি আমার বাবার খোঁজ পাই।মা প্রবল ভাবে আহত হয়েছিল।

দাড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তির পায়ের চাপ পড়ে যায় সিড়ির পাথরের গায়। ছবি: GETTY IMAGES

এই বর্বর হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া অপর এক ব্যক্তি কেকো ওগুরা । তিনি ছিলেন হিরোশিমার একজন সারভাইভার। দুর্ঘটনার কয়েক বছর পরে ওই ব্যক্তি বিবিসির রুপার্ট উইঙ্গফিল্ড হায়েসের কাছে তিনি সেদিনের কথা স্মরণ করছিলেন। নিজের চোখে দেখা আনবিক বোমা হামলার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তিনি ছড়িয়ে দিচ্ছেন মানুষের মাঝে। তিনি তার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গি বলেন-

১৯৪৫ সালের ৬ই অগাস্ট, নিজের বাড়ির সামনেই দাড়িয়েছিলেন তিনি।অবর্ণনীয় শব্দ আর তীব্র আলোকচ্ছটা ঘিরে ধরে আমাকে। আমি ছিটকে রাস্তায় পড়ে যাই। তারপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। কিছুক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরতেই আমি দেখি আহত ভয়ার্ত মানুষেরা আমার বাড়ির আশপাশে জড়ো হতে থাকে। তাদের চামড়া খুলে খুলে পড়ছিল। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম তারা হয়তো গায়ের সঙ্গে একটি চাদর বা অন্য কিছু জড়িয়ে আছে এবং ধরে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু আসলে সেটি ছিল তাদের গায়ের চামড়া এবং খুলে পড়ে যাওয়া ঠেকাতে তারা ধরে রেখেছিল। হঠাৎ কেউ একজন আমার পা জড়িয়ে ধরল।

তারপর বলল, আমাকে পানি দাও। তারপর সবাই একসাথে বলতে শুরু করলো, পানি দাও, পানি দাও। আমি তখন আমাদের কুয়া থেকে পানি তুলে আনলাম, এবং তাদের খেতে দিলাম। বেশীরভাগই পানি পান করে আমাকে ধন্যবাদ দিল। কিন্তু কয়েকজন পানি পান করার পরপরই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো।

বিস্ফোরণে এক নারীর শরীরের চামড়া পুড়ে খসে পড়ছে। ছবি: GETTY IMAGES

হিরোশিমার যে স্থানটিতে পড়ে বিস্ফোরিত হয়েছিল পারমানবিক বোমা সেখানে এখন তৈরি হয়েছে পিস পার্ক। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থীকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন কোকো। এদের সবাই এই প্রথমবারের মতো একজন হিরোশিমা সারভাইভরের মুখোমুখি হলেন।

প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ছাত্র জামাল ম্যাডক্স বলছিলেন,

আমাদের শেখানো হয়েছে যে, বিজ্ঞানের অসাধারণ একটি আবিষ্কার হিরোশিমার ওপর ফেলা হয়েছে, কয়েক মুহূর্তের একটি আলোকচ্ছটা তৈরি হয়েছে, আর তাতেই যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু এটা ছিল একেবারেই পরাবাস্তব ব্যাখ্যা। আমি যখন চিন্তা করি যে সেদিনের সেই দুঃস্বপ্ন আজো সেখানকার মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় তখন আমি দারুণ দুঃখভারাক্রান্ত হই।

যুদ্ধের ঠিক পরপর জাপান যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি দখলে থাকার কারণে আণবিক বোমাসংক্রান্ত সব রকম খবর প্রচারের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা এবং পরবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে সামাজিকভাবে করুণার দৃষ্টিতে দেখার প্রবণতা জাপানিদের মধ্যে নিজেদের গুটিয়ে রাখার মনোভাব জাগিয়ে তুলেছিল।

ম্যানহাটান প্রকল্প নামে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রের আণবিক বোমা তৈরির গবেষণার প্রধান মার্কিন জেনারেল লেসলি গ্রোভস মার্কিন সিনেটের এক শুনানিতে বলেছিলেন যে,

উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে এসে মৃত্যুবরণ করা কার্যত হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত যন্ত্রণা ভোগ না করে মারা যাওয়া এবং সত্যিকার অর্থে সেভাবে মারা যাওয়া হচ্ছে বেশ সুখকর এক অভিজ্ঞতা।

লিটলবয় নিক্ষেপের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট। তবে বোমাহামলার নির্দেশ দেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হেনরি ট্রুম্যান। জাপানিদের জব্দ করা আর জাপানকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করানোর জন্যই হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে হামলা চালায় মার্কিনিরা। হামলার ৭৬ বছর হয়ে গেলেও ভয়াল সেই দিনের কথা এখনো ভোলেনি জাপানের মানুষ। এখনো সেদিনের দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে হিরোশিমার ও নাগাসাকির মানুষ। আণবিক বোমা হামলার এতো বছর পরও শহর দুটোতে জন্ম নিচ্ছে বিকলাঙ্গ শিশু, অনেকে ভুগছে ক্যান্সারসহ দুরারোগ্য অনেক রোগে।

বিস্ফোরণে পুড়ে যাওয়া ঘড়িটি সময় দেখাচ্ছে ৮টা ১৫ মিনিট। ছবি: GETTY IMAGES

পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহতা কঠিন ও ভয়ংকর পরিণতির দিকে আমাদের পৃথিবীকে ঠেলে দিতে পারে। এটা সারা বিশ্বের বিবেকমান মানুষ সহজেই তা আঁচ করতে পারেন, হিরোশিমা অথবা নাগাসাকিকে দেখে। ধ্বংসের ভয়াবহতা ও এর পরিণতির প্রায় সাত দশকের অপ্রাপ্তি দেখে জাপান এখন শান্তিতে বিশ্বাসী।

এই শাখা থেকে আরও পড়ুনঃ

সর্বশেষ আপডেট