বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ভারত উপমহাদেশে শিক্ষা বিস্তারে 'ডেসপ্যাচ' 

 

ভারত উপমাহদেশে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রসারে স্যার চার্লস উড –এর ডেসপ্যাচ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রফেসর এস.এন. মুখার্জি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “ভারতের শিক্ষার ইতিহাস -এ ডেসপ্যাচকে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি দলিল বলে উল্লেখ করেছেন। এটি এমন একটি পরিকল্পনা যাতে ভারতীয় শিক্ষার সমস্ত দিককে যুক্ত করা হয়েছিল, আরও ভালোভাবে বলতে গেলে প্রস্তাবনাটিতে ইংরেজি এবং ভারতীয় ভাষার তুলনামূলক অবস্থানকে সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে। প্রস্তাবনাটির উদ্দেশ্য অত্যন্ত আন্তরিক হলেও তৎকালীন সরকার এটিকে বাস্তবায়নে ব্যার্থ হয়।

১৮৫৪ সালের ১০ই জুলাই ভারতে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে স্যার চার্লস উড বেশ কিছু সুপারিশ করে একটি শিক্ষা প্রস্তাব প্রকাশ করেন। যা ডেসপ্যাচ নামে পরিচিত। মূলত এর উপর ভিত্তি করে ভারতে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এই শিক্ষা ব্যবস্থার আগে ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা অনেকটা উদ্দেশ্যহীন বলে পরিগণিত হতো। পরবর্তীকালে এই নির্দেশ নামা ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থায় ম্যাগনাকার্টা বা মহাসনদ বলে পরিচিতি পায়।

ভারতীয় শিক্ষানীতি নির্দিষ্ট কোন পাঠক্রম গঠনের উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছিল না। লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক এর আমল পর্যন্ত কিছু বেসরকারি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, যদিও তাদের শিক্ষানীতি পরিকল্পিত ছিল না।

ভারতে শিক্ষা সংক্রান্ত নানা সমস্যার সমাধান করার কোম্পানির পরিচালক সমিতির সভাপতি স্যার চার্লস উড ‘শিক্ষা বিষয়ক প্রস্তাব’ [Wood’s Education Despatch] নামে একটি শিক্ষা নীতি রচনা করে ভারতে পাঠান। এতে ভারতে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রসারের জন্য বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়। সেগুলো হলো-

  • ১. শিক্ষার প্রসারের জন্য ভারতের প্রতিটি প্রদেশে একজন শিক্ষা কর্মকর্তার অধীনে একটি করে স্বতন্ত্র শিক্ষাবিভাগ চালু করা।
  • ২. লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শে প্রেসিডেন্সি শহরগুলিতে তথা কলকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বাই -এ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় ।
  • ৩. সরকারি মডেল স্কুলগুলোর সংখ্যা বৃদ্ধি করা ।
  • ৪. মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা ও নারীশিক্ষার প্রসারের ব্যাপারে জোর দেওয়া ।
  • ৫. প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারেরে জন্য দেশীয় বিদ্যালয়গুলোর উন্নতি সাধন করা ।
  • ৬. শিক্ষকদের প্রশিক্ষন দেওয়ার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা করা ।
  • ৭. বেসরকারি স্কুলগুলিতে সরকারি অনুদান বা গ্র্যান্ট ইন এড প্রথা চালু করা ।
  • ৮. সাধারণ শিক্ষা মাতৃভাষায় করা এবং ইংরেজি শিক্ষা লাভে আগ্রহ বৃদ্ধি করা।
  • ৯. সমস্ত শিক্ষা ব্যবস্থাকে পাঁচটি শ্রেণীতে ভাগ করে নেওয়া।
  • ১০. সর্বোপরি মেধাবী ছাত্রদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়।

১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের চার্টার অ্যাক্টে ভারতীয় জনগণের শিক্ষার বিস্তারের জন্য কোম্পানির তহবিল থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা করা হলেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পরিচালিত সরকার শিক্ষাকে সঠিক অর্থে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবে মেনে নেয়নি। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে ধীরে ধীরে অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ালেও, কোনো সুনির্দিষ্ট নীতি অনুসরণ করে শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হয়নি। এ থেকে স্যার চার্লস উড সর্বপ্রথম একটি সুসংগঠিত শিক্ষা প্রস্তাব প্রকাশ করেন।

এই শিক্ষানীতির মাধ্যমে ভারতের মানুষকে শিক্ষিত ও আধুনিক করে তোলার চেষ্টা করা হয়। ভারতের জনগণকে শ্রম ও পুঁজি বিনিয়োগের ফলাফল বুঝতে এবং দেশজ প্রাকৃতিক সম্পদের অর্থনৈতিক গুরুত্ব উপলব্ধি করতে শিক্ষা বিস্তার অপরিহার্য মনে করেই ডেসপ্যাচ প্রকাশ করা হয়।

উড-এর ডেসপ্যাচে প্রাচ্যশিক্ষার গুরুত্বকে স্বীকার করা হলেও প্রাচ্য শিক্ষাকে মূল্যায়ণ করা হয়নি। অন্যদিকে, প্রাচ্য বিজ্ঞান ও দর্শনের পরিবর্তে পাশ্চাত্য কলা, বিজ্ঞান, দর্শন ও সাহিত্যকেই ভারতবাসীর কাছে শিক্ষার বিষয়বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। ভারতীয় জনগণ যাতে ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে ইংরেজি ও দেশীয় ভাষা উভয়ই ব্যবহার করতে পারে সে ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া হয়।

কোম্পানির অন্তর্ভুক্ত পাঁচটি প্রদেশ তথা বোম্বাই, মাদ্রাজ, পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ ও বাংলায় একটি করে সরকারি শিক্ষা বিভাগ স্থাপনের সুপারিশ করা হয়।

প্রস্তাবটিতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের গুরুত্বকে তুলে ধরা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শে স্থাপিত হবে। কলকাতা, বোম্বাই এবং মাদ্রাজে একটা করে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন একজন আচার্য, একজন উপাচার্য এবং কয়েকজন সরকার মনোনীত সদস্যের দ্বারা গঠিত ‘সিনেট’।

ডেসপ্যাচে স্তরবিন্যস্ত শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের সুপারিশও করা হয়। এই সুপারিশে বলা হয় স্তরবিন্যস্ত শিক্ষাব্যবস্থার চূড়ায় থাকবে বিশ্ববিদ্যালয় ও তার অধীনস্থ মহাবিদ্যালয়সমূহ, মাঝে থাকবে হাইস্কুল শিক্ষা তথা মাধ্যমিক শিক্ষা এবং সর্বনিম্ন স্তরে থাকবে প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক ও সাধারণ শিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষাকে প্রাধান্য দেয়া হলেও উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষাকেই প্রধান্য দেয় হয়। ভারতে শিক্ষার বিষয়বস্তু হিসেবে পাশ্চাত্য দর্শন ও বিজ্ঞানকে নির্বাচন করা হয়। তাই শিক্ষার্থীদের কাছে সহজে পৌঁছানোর জন্য উড-এর ডেসপ্যাচে পাশ্চাত্য দর্শন ও বিজ্ঞান-এর ইংরেজিতে লেখা বইগুলিকে দেশীয় ভাষায় অনুবাদের জন্য সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

এই প্রস্তাবনায় শিক্ষকদের এদেশের শিক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের জন্য সাধারণ স্কুল প্রতিষ্ঠা এবং প্রশিক্ষণ গ্রহণ কালে তাদের বৃত্তিদানের সুপারিশ করেন। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি আইন, চিকিৎসাশাস্ত্র, কারিগরি ও প্রযুক্তিবিদ্যা প্রভৃতি বৃত্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলনের সুপারিশ করা হয়।

প্রস্তাবনাটিতে নারী শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারূপ করা হয়। এবং অধিক সংখ্যায় গার্লস্ স্কুল স্থাপনের সুপারিশ করা হয়।
মুসলমান রাজশক্তিকে পরাস্ত করে, ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাই এদেশে মুসলমান সম্প্রদায়ের ইংরেজ-বিদ্বেষ ছিল প্রবল। এই বিদ্বেষের কারণে মুসলমানরা ইংরেজ-প্রবর্তিত শিক্ষায় কোনো আগ্রহ প্রকাশ করেনি। ফলে তারা আধুনিক শিক্ষার দিক থেকে অনেকখানি পিছিয়ে পড়েছিল। এই অবস্থার উন্নতি ঘটানোর জন্য উড-এর ডেসপ্যাচে মুসলমানদের জন্য পৃথক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার সুপারিশ করা হয়।

বেসরকারি বিদ্যালয়সমূহকে উৎসাহদানের উদ্দেশ্যে শর্তসাপেক্ষে ‘grant-in-aid’ প্রথা প্রবর্তনের সুপারিশ করা হয়। ৫ (পাঁচ) টি শর্তে বেসরকারি বিদ্যালয়গুলো অর্থ সহায়তা নিতে পারবে। শর্তগুল হলো-

  • ১. বিদ্যালয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখা।
  • ২. বিদ্যালয়ের পরিচালন কমিটি আইনানুগভাবে নির্বাচিত হওয়া।
  • ৩. বিদ্যালয় পরিদর্শকের নির্দেশানুসারে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনা।
  • ৪. বিদ্যালয় ছাত্রদের কাছ থেকে সামান্য পরিমাণ হলেও বেতন আদায় করা।
  • ৫. শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, শিক্ষার মান ও ফলাফল উন্নত করা।

কেন্দ্রীয় শিক্ষা ব্যবস্থা প্রনয়নের কারণে ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। বরাবরের মত ভারতীয় ভাষা এবং ভারতীয় সংস্কৃতি পশ্চাৎপদ এবং অবহেলিত ছিল। সর্বোপরি, প্রস্তাবনাটি ভারতে ইংরেজি শিক্ষার ভিত্তি স্থাপন করেছিল আদতে প্রস্তাবনাটির গণশিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবে পরিণত হয়নি। তহবিলের অভাব এবং অনিয়ম থাকায় অনুদান-সহায়তা ব্যবস্থা কার্যকর হয়নি। পশ্চিমা জ্ঞান এবং সংস্কৃতি প্রচারে প্রস্তাবনাটির আগ্রহ লক্ষণীয়। জনশিক্ষা অধিদফতর জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষার আগ্রহ সৃষ্টিতে ব্যার্থ হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পড়াশোনার পদ্ধতি ভারতীয় অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে নি।

তবে ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, মুম্বই বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় এর মতো নতুন প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়, পাশাপাশি ১৮৮২ সালে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৮৮৭ সালে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এগুলো ছিলো ডেসপ্যাচ প্রস্তাবনার সাফল্য।

সর্বশেষ আপডেট