শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বিপ্লবী শহীদ ক্ষুদিরাম বসু: ফাঁসির কাষ্ঠে দাঁড়িয়ে ছিলেন অবিচল

 

হাসি হাসি পরব ফাঁসি, দেখবে ভারতবাসী। প্রায় দুইশ বছর শাসন করা ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্তি পেতে আন্দোলন সংগ্রামে যারা অগ্রগামী ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন ক্ষুদিরাম বসু। কলকাতা: দেশের সর্বকনিষ্ঠ স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবে হাসিমুখে ফাঁসির দড়ি বরণ করে নিয়েছিলেন তিনি। ফাঁসি হওয়ার সময় ক্ষুদিরামের বয়স ছিল ১৮ বছর, ৭ মাস এবং ১১ দিন।

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ও স্বদেশী আন্দোলনের কর্মীদের কঠোর সাজা ও দমননীতির কারণে, কলকাতার প্রধান প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন। ইংরেজ বিচারক কিংসফোর্ডকে হত্যা চেষ্টাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো ক্ষুদিরামের সংগ্রামী জীবনে। ক্ষুদিরাম বসু তাঁর শিক্ষক সত্যেন্দ্রনাথ বসুর কাছ থেকে এবং শ্রীমদ্ভগবদগীতা পড়ে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে বিপ্লব করতে অনুপ্রাণিত হন। প্রথমে একটি বিশেষ ধরণের বই বোমার সাহায্যে কিংসফোর্ডকে হত্যার চেষ্টা করেছিলেন। যা ছিলো হেমচন্দ্রের তৈরী এক বিশেষ পদ্ধতি। এটি তৈরী হয় ক্যডবেরি কোকোর খালি টিন, পিকরিক এসিড ও ডোটেনেটর এর সাহায্যে। প্রথমে একটা ক্যাডবেরি কোকোর খালি টিনে এক পাউন্ড পিকরিক অ্যাসিড এবং তিনটে ডেটোনেটর নেওয়া হয়। পরে হার্বার্ট ব্রুমএর কমেন্টারিজ অন দ্য কমন ল বইয়ের ফাঁপা অংশে প্যাক করা হয়েছিল এবং বাদামি কাগজ দিয়ে মুড়ানো হয়। নবীন বিপ্লবী পরেশ মল্লিক এই বই বোমাটি কিংসফোর্ডের বাড়িতে দিয়ে আসেন।

ক্ষুদিরাম বসু ভাস্কর্য

কিন্তু ইংরেজ বিচারক ম্যাজিস্ট্রেড কিংসফোর্ড প্যাকেটটা তাৎক্ষনিক না খুলে পরে দেখবেন বলে তার সেলফে রেখে দেন। ১৯০৮ সালের মার্চ মাসে ইংরেজ সরকার বিচারক কিংসফোর্ডকে পদোন্নতি দেন। এবং নিরাপত্তা জনিত কারণে তাকে ও নিরাপত্তা বিহারের মুজাফফরপুর জেলার বিচারপতি হিসেবে বদলি করেন। তার সাথে স্থানান্তরিত হয় বই, আসবাব-পত্র ও পরেশ মল্লিকের রেখে আসা বই বোমা। তখনও থেকে ছিলো না কিংসফোর্ডকে হত্যা চেষ্টা। এপ্রিলে প্রফুল্ল চাকি যখন মুজাফফর পুরে ফিরেছিলেন তখন তার সাথে একটা নতুন ছেলেকে দেখা গিয়েছিলো যিনি ছিলেন ক্ষুদিরাম বসু।

১৯০৮ সালের ২৯ এপ্রিল স্কুল ছাত্রের ভান করে মুজাফফরপুর পার্কে তারা সমীক্ষা করেছিলেন ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল। এই জায়গাটিতে ডগলাস কিংসফোর্ড ঘন ঘন আসেন। তবে সেদিন একজন কনস্টেবল তাদের দেখেছিলো।

৩০ এপ্রিল ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল যখন কিংসফোর্ডের উপর আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয় সেদিন সন্ধ্যায় প্রিঙ্গল কেনেডি নামে একজন ব্রিটিশ ব্যারিস্টারের মেয়ে এবং স্ত্রীর সঙ্গে কিংসফোর্ড এবং তার স্ত্রী ব্রিজ খেলছিলেন। রাত ৮টা ৩০ মিনিটে কিংসফোর্ড ও পিঙ্গল কেনেডি’র পরিবার বাড়ি ফিরতে মনস্থ করেন। এবং গাড়িতে উঠেন। উল্লেখ্য পিঙ্গল কেনেডির স্ত্রী’র গাড়িটিও কিংসফোর্ডের গাড়িটির মতই ছিলো। এবং কেনেডির পরিবার সেদিন কিংসফোর্ডের বাড়ির চত্বর থেকেই যাচ্ছিলেন। গাড়িটা যখন কিংসফোর্ড বাড়ির চত্বরের পূর্ব ফটকে পৌঁছায় তখন ক্ষুদিরাম বসু এবং প্রফুল্ল চাকি গাড়িটির দিকে বোমা ছুড়ে মারেন। সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটলো। কিন্তু ক্ষুদিরাম ভুল গাড়িতে আক্রমণ করে। এটি ছিলো পিঙ্গেল কেনেডির পরিবারের গাড়ি।

বিস্ফোরণে ভাঙ্গা গাড়িটি ডগলাস কিংসফোর্ডের বাড়িতে আনা হয়। কেনেডির স্ত্রী ও কন্যা মারাত্মকভাবে আহত হয়। পিঙ্গেল কেনেডির কন্যা এক ঘন্টার মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন। এবং মিসেস কেনেডি মারাত্মক আঘাতের ফলে ২ মে মৃত্যুবরণ করেন।

ওয়াইনি রেল স্টেশন থেকে আটক ক্ষুদিরাম

ইতিমধ্যেই কিংসফোর্ডের উপর আক্রমণের খবর সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। সকাল হতেই সকল স্টেশনে সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন করা হয়। প্রত্যেক যাত্রী ও সাধারণ নাগরিকদের উপর নজর রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। বিপ্লবীদের পলায়নের সকল রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়। ক্ষুদিরাম এবং প্রফুল্ল চাকি নিজেদের মাতো নিজেদেরকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। ক্ষুদিরাম ২৫ মাইল পায়ে হেঁটে ওয়াইনি নামে এক স্টেশনে পৌঁছেন। যখন তিনি একটি চায়ের দোকানে এক গ্লাস জল খেতে চেয়েছিলেন তখন ফতে সিং এবং শিউ প্রসাদ সিং নামে দুজন কনস্টেবলের মুখোমুখি হন। কনস্টেবলদ্বয় ক্ষুদিরামের ময়লা পা এবং বিধ্বস্ত ও ঘর্মাক্ত চেহারা দেখে কিছু সন্দেহ করে। কয়েকটা প্রশ্ন করার পর তাদের সন্দেহ বেড়ে যায় এবং তারা ক্ষুদিরামকে আটক করার সিদ্ধান্ত নেয়।

ক্ষুদিরাম দুজন কনস্টেবলের সঙ্গে সংগ্রাম শুরু করে। তখন তার কাছে থাকা দুটো রিভলভারের একটা পড়ে যায়। এবং অন্যটা দিয়ে যখন তিনি একজন কনস্টেবলকে গুলি করতে উদ্যোত হন তখন অন্যজন পেছন থেকে শক্তভাবে তাকে জড়িয়ে দরেন। অল্পবয়সী, পাতলা গড়নের ক্ষুদিরামের পক্ষে নিজের প্রতিরক্ষার কোন সম্ভাবনা ছিলো না। তাকে আটক করা হয়। গ্রেফতারের সময় ক্ষুদিরাম বসুর কাছে ৩৭ রাউন্ড গোলাগুলি, ৩০ টাকা নগদ, একটা রেলপথের মানচিত্র এবং একপাতা রেলের সময়সারণি ছিল। অন্যদিকে প্রফুল্ল চাকি গ্রেফতার এড়াতে নিজের মুখে নিজে গুলি করে আত্মহত্যা করেন।

ক্ষুদিরাম বন্দি হয়েছিলেন ওয়াইনি রেলওয়ে স্টেশন থেকে। বর্তমানে রেলওয়ে স্টেশনটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘ক্ষুদিরাম বোস পুসা স্টেশন’।

১৯০৮ সালের ১লা মে, হাতকড়ি লাগানো ভারতের কনিষ্ঠতম বিপ্লবী ক্ষুদিরামকে আনা হয় মুজাফফরপুর। তাঁকে রাখা হয় জেলাপ্রশাসক মি. উডম্যানের বাড়িতে। পরে শুরু হয় বিচার কার্যক্রম।

চিনতে নাকি সোনার ছেলে
ক্ষুদিরামকে চিনতে?
রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিল যে
মুক্ত বাতাস কিনতে
আল মাহমুদ

ক্ষুদিরাম বসুকে সমর্থন করেন নি তৎকালীন কংগ্রেসের নেতা মহাত্মা গান্ধী। বরং উল্টো ইংরেজদের বিরুদ্ধে হিংসাকে নিন্দা করেন। একই সাথে কেনেডির পরিবারের মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করেন। মহাত্মা গান্ধী বলেন,

ভারতীয় জনগণ এই পদ্ধতির মাধ্যমে তাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে পারবেনা। (তথ্যসূত্র)

তবে কেশরী সংবাদপত্রে বাল গঙ্গাধর তিলক ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকিকে সমর্থন করে আওয়াজ তোলেন। কিন্তু এর ফল স্বরূপ ইংরেজ সরকার দেশদ্রোহিতার অপরাধে গঙ্গাধর তিলককে গ্রেফতার করে।

ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকি

মৃত্যু যে কত সহজে বরণ করে নেওয়া যায় তা শিখিয়ে গেছে ক্ষুদিরাম। ফাঁসির মঞ্চে ওঠার সময়ও ক্ষুদিরামের মুখে লেগে ছিল হাসি। যেন দেশের জন্য প্রাণ দিতে পেরে তিনি দারুন খুশি। ব্রিটিশ সরকারের চারজন পুলিশ তাঁকে ফাঁসির মঞ্চ পর্যন্ত নিয়ে আসে। ফাঁসি মঞ্চের সামনে থাকা আইনজীবীদের দিকে তাকিয়ে হাসেন ক্ষুদিরাম। গলায় ফাঁসির দড়ি পরানোর পর জল্লাদকে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন ‘আচ্ছা, ফাঁসির দড়িতে মোম দেওয়া হয় কেন?’ শহিদ ক্ষুদিরামের জীবনের শেষ কথা ছিল সেটাই। জল্লাদ বিস্ময়ে আর কিছু বলতে পারেননি। এঘটনায় হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন ব্রিটিশ জেলারও। ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

 

২ মে ১৯০৮ সালের ইংরেজি দৈনিক দ্য স্টেটসম্যান এক প্রতিবেদনে বলেছিলেন,

একটা ছেলেকে দেখার জন্যে রেল স্টেশনে ভিড় জমে যায়। ১৮ অথবা ১৯ বছরের এক কিশোর হলেও তাঁকে রীতিমতো দৃঢ় দেখাচ্ছিল। বাইরে তার জন্যেই রাখা এক চারচাকার খোলা গাড়িতে উঠতে প্রথম শ্রেণীর এক রেল কামরা থেকে বেরিয়ে সে হেঁটে আসছিল, এক উৎফুল্ল কিশোরের মতো, যে কোনো উদ্বেগ জানেনা….গাড়িতে নির্দিষ্ট আসনে বসার সময় ছেলেটা চিৎকার করে বলে উঠলবন্দেমাতরম্

ক্ষুদিরাম বসু ডিসেম্বর ১৮৮৯ তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত মেদিনীপুর জেলা শহরের কাছাকাছি কেশপুর থানার অন্তর্গত মোহবনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ত্রৈলক্যনাথ বসু ছিলেন নাড়াজোল প্রদেশের শহরে আয় এজেন্ট। তার মা লক্ষীপ্রিয় দেবী। তিন কন্যার পর তিনি তার মায়ের চতুর্থ সন্তান। তার দুই পুত্র আগেই মৃত্যুবরণ করেন। অপর পুত্রের মৃত্যুর আশঙ্কায় তিনি তখনকার সমাজের নিয়ম অনুযায়ী তার পুত্রকে তার বড় বোনের কাছে তিন মুঠি খুদের (শস্যের খুদ) বিনিময়ে বিক্রি করে দেন। খুদের বিনিময়ে ক্রয়কৃত শিশুটির নাম পরবর্তীকালে ক্ষুদিরাম রাখা হয়। ক্ষুদিরাম বসু পরবর্তিতে তার বড় বোনের কাছেই বড় হন।

এই শাখা থেকে আরও পড়ুনঃ

সর্বশেষ আপডেট