শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ইতিহাসের একমাত্র সুলতান যিনি একই সাথে যুদ্ধ করেছেন চারটি ভিন্ন ভিন্ন শক্তির সাথে

 

সিন্ধু নদের প্রচন্ড স্রোতের দিকে তাকিয়ে আছে চেঙ্গিস খান। তার প্রতিপক্ষ সিন্ধু নদ পাড়ি দিয়ে ওপারে উঠে দাড়িয়েছে। সর্বাঙ্গ তার ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে। বালুময় সিন্ধু নদের পাড়ে ঘোড়া থেকে নেমে গায়ের জামা খুলে নিলো সে। ঘোড়ার পিঠ থেকে জিনটা হটিয়ে দিয়ে বসার গদিটা বের করলো। তারপর সেই বালুকাময় পাড়েই বর্শাটা গেঁথে নিয়ে টানিয়ে দিল শাহি ছাতাটা। হঠাৎ একটা চকিত দৃষ্টি নিজের অজান্তেই এপারে দাঁড়ানো চেঙ্গিস খানের দিকে পড়ে। নিতান্ত অনিচ্ছা সত্বেও যেন বিকট অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন সেই মুজাহিদ।

জগতের সবচেয়ে বড় দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দুইদিক থেকে একে অন্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। ওপারে সুলতান জালালুদ্দিন আর এপারে চেঙ্গিস খান। জালালুদ্দিনের চোখে যেন তখন ঠিকরে বেরোচ্ছিল প্রতিজ্ঞা। যেন বলতে চাচ্ছিলেন, আমি ফিরে আসবো। এখানেই সবকিছুর শেষ ভেবো না চেঙ্গিস খান। যুদ্ধতো কেবল শুরু হয়েছে। আমি আবার ফিরে আসবো।

ইতিহাস সবসময় বিজয়ীকেই ফলাও করে প্রচার করে। বিজয়ীর গুনকীর্তনেই যেন ইতিহাসের পরিপূর্ণতা। ইতিহাস পরাজয় আর পরাজিতকে সবসময়ই স্মৃতির আড়ালে ঢেকে রাখতে চায়। পরাজিত সৈনিককে ইতিহাসের কোন অজানা এক অন্ধকার গলিতেও এতটুকু ঠাই দিতে চায় না। তবুও কোন কোন পরাজিত সৈনিক আর পরাজিত পক্ষ এতটাই মহিয়ান হয়ে উঠে যে তা গৌরবের দিক থেকে বিজয়কেও ছাড়িয়ে যেতে পারে অনেক অনেক দূরে। ইতিহাসের তেমনই এক মহানায়ক ছিলেন সুলতান জালালুদ্দিন আল খাওয়ারিজম শাহ।

সময়টা তখন মুসলিম বিশ্বের জন্য ছিল খুবই সংকটাপন্ন। একদিকে বাগদাদের খিলাফত তখন তাদের হারানো সমস্ত গৌরব পিছনে ফেলে ধ্বংসের দারপ্রান্তে পৌছে গিয়েছে। আব্বাসী খিলাফতের সোনালী সূর্যটা তখন প্রায় অস্তমিত হয় হয় অবস্থা। একদিকে সালজুক সাম্রাজ্যের নতুন উদিত সূর্যটা তখন পুরোমাত্রায় আলো ছড়িয়ে চলছিল । সালাউদ্দিন আইয়ুবীর সাম্রাজ্য তখন ইতিহাস মাত্র। মিশরের ফাতেমী সাম্রাজ্যটা তখনও বিভিন্ন ফেতনা ছড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। এরইমাঝে নতুন এক সম্ভাবনার স্বপ্ন নিয়ে যেন ইসলামের ইতিহাসে আরো একটা নক্ষত্রের আগমন ঘটে। সুলতান আলাউদ্দি মুহাম্মদ আল খাওয়ারিজম শাহের হাত ধরে গড়ে ওঠা সেই সাম্রাজ্যের নাম ছিল খাওয়ারিজম সাম্রাজ্য। দোর্দন্ডপ্রতাপে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে করতে একটা সময় যিনি সালজুক আর বাগদাদের খিলাফতের মাথাব্যাথার কারন হয়ে উঠেছিলেন।

নিজের সাম্রাজ্য নিয়ে চিন্তিত তৎকালীন আব্বাসী খলিফা নাসির লী দ্বীনিল্লাহ তখন ঘৃন্য এক ষড়যন্ত্র করে বসেছিলেন। যা আজো মুসলিম ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় বলে বিবেচনা করা হয়। তিনি নিজের খিলাফতি সাম্রাজ্য বাঁচানোর জন্য সূদুর গোবী মরুভূমি থেকে ডেকে নিয়ে এসেছিলেন একদল ক্ষুধার্ত, বর্বর আর হায়েনা জাতিকে। পৃথিবীর ইতিহাসে যাদের নাম আজীবন ঘৃৃনাভরে উচ্চারিত হয়ে যাবে ‘তাতার বাহিনী’ নামে।

চেঙ্গিস খানের আক্রমনে লন্ডভন্ড তখন খাওয়ারিজম সাম্রাজ্য। মঙ্গোলিয়ানদের বর্বরতায় মানুষ তখন ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে উঠেছে। চেঙ্গিস খান ও তার পুত্র জোচি খান, তোলি খান যেন সাক্ষাত মৃত্যুদূত হয়ে খোরাসানের মাটিতে আগমন করেছিল। একটা সময় মুসলমানরা ভাবতে শুরু করেছিল এরাই বুঝি ইয়াজুজ মাজুজ। ইস্পাহান, বোখারা, সমরকন্দ, খোরাসান, আরগেঞ্চ কোথায় তারা হামলা করেনি। যেখানেই হামলা করেছে সেখানেই জীবিত কাওকে ছাড়েনি। ইতিহাসের এই সময়কার বর্ণনাগুলো পড়লে যেন বিশ্বাসই করতে ইচ্ছে করে না। মানুষ কি করে এতটা নির্দয় হতে পারে। লক্ষ লক্ষ মানুষকে তারা স্রেফ খুন করে গিয়েছে। বাদ যায়নি নারী, বৃদ্ধ বা শিশুরাও। এদের ক্রোধ থেকে বাঁচতে পারেনি মায়ের পেটে থাকা বাচ্চার ভ্রুনটাও। গর্ভবতী মায়ের পেট কেটে বাচ্চা বের করে তাকেও খুন করেছে এই নরপিশাচের দলগুলো। একজন ঐতিহাসিক যথার্থই বলেছেন, “যখন এরা কোন শহর থেকে বের হয়ে যেতো তখন পিছনের রেখে যাওয়া সে শহরে প্রানের কোন স্পন্দন পর্যন্ত থাকতো না”।

মুসলমানদের এমন দুর্দিনে তাদেরকে বাঁচাতে আল্লাহর পক্ষ থেকে যেন ধুমকেতুর ন্যায় আবির্ভূত হয়েছিলেন মুসলমানদের ত্রাতা হিসেবে একজন মর্দে মুজাহিদ। যিনি বুক চিতিয়ে সারা জিবন লড়ে গিয়েছেন এই তাতার বাহিনীর সাথে। তাতারদের মোকাবেলয় তার প্রতিরোধ অসফল হলেও ব্যার্থ ছিলো না মোটেই। অন্তত সাত আটটা বছর তিনি ঠেকিয়ে রেখেছিলেন তাদের বিজয়ের স্রোত। দৌড়ের উপর রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন সেই বিশ্বত্রাস চেঙ্গিস খান ও তার পুত্র জোচি খানকে। অনেক ক্ষেত্রে সম্মুখ যুদ্ধে নাকানি চুবানি পর্যন্ত খাইয়েছিলেন। এই রক্তপিপাসু জাতিকে নিজের সাথে যুদ্ধে আটকে রেখে দিয়ে গিয়েছিলেন বাগদাদের খিলাফত, হারামাইন শরীফ মুসলিম বিশ্বসহ মানবতার সুরক্ষা। বলছিলাম সুলতান খাওয়ারিজমের শেষ সুলতান জালালুদ্দিন আল খাওয়ারিজম শাহের কথা।

ইতিহাসের একমাত্র যোদ্ধা যিনি একই সাথে যুদ্ধ করেছেন চারটি ভিন্ন ভিন্ন শক্তির সাথে

১। চেঙ্গিস খানের তাতার বাহিনী

২। ক্রুসেডার বাহিনী

৩। খারেজীদের আলামুত দূর্গের বিরুদ্ধে

৪। ভারতবর্ষের হিন্দু রাজাদের বিরুদ্ধে

সিন্ধু নদের তীরে বিরত্বের যে মহাকাব্য তিনি রচনা করেছিলেন তা চিরকাল মুসলমানদের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

তাতারদের প্রথম আক্রমনে তার পিতা যখন সাম্রাজ্য হারিয়ে বসেছেন তখনও তিনি দমে যাননি। নতুন করে বহু বছর ধরে একটু একটু করে নিজের সাম্রাজ্য গুছিয়ে নিয়েছেন। বারবার ফিরে এসেছেন চেঙ্গিস খানের সামনে। এ যেন এক দুর্ভেদ্য প্রাচীর। কোনভাবেই যা তাতার বাহিনী টলতে পারছিল না। মঙ্গোলদের সমস্ত আক্রমন যেন জালালুদ্দিন নামক এই দেয়ালটা একাই রুখে দিচ্ছিল। যার বিরত্বে স্বয়ং চেঙ্গিস খান তার বড় পুত্র জোচিকে বলেছিল, “ব্যাটা, হবি তো এমনই হ। সেই পিতা খুব সৌভাগ্যবান যার পুত্র এমন বিস্ময়কর বাহাদুর। ওর মত জোয়ান মর্দ সারা দুনিয়ায় পয়দা হয়নি আর হবেও না। এই লোক আগুন পানি দুটোরই মরনছোবল থেকে বেঁচে অনন্য শক্তিমত্তা দিয়ে উঠে গেছে মুক্তির তটে।

সুলতান জালালুদ্দিনের মৃত্যু নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। কারো মতে, তিনি কুর্দিদের হাতে নিহত হয়েছেন। আবার কেউ বলেন, দস্যু কিংবা ব্যক্তিগত শত্রুতার জের ধরে তাকে হত্যা করা হয়েছিল। তবে জীবনের শেষ সময়ে তিনি ছিলেন প্রায় নিঃসঙ্গ। মৃত্যুর সময় কোনো সেনাবাহিনী তার সঙ্গে ছিল না। সে সময় তিনি অসুস্থও হয়ে পড়েছিলেন। পুরোটা জীবন নৃশংস মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে লড়াই করে ১২৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট, সুলতান জালালুদ্দিন মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৩২ বছর।

এই শাখা থেকে আরও পড়ুনঃ

সর্বশেষ আপডেট