ফিলাডেলফিয়া পরীক্ষণ: জাহাজ ও মানুষের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া ঘটনা; কতটা যৌক্তিক?
২২শে অক্টোবর ১৯৪৩ সাল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হওয়ার প্রায় দু’বছর পূর্ণ হতে চলছে। ১৯৪১ সালের ৭ই ডিসেম্বর জাপান কর্তৃক পার্ল হারবার আক্রান্ত হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর চুপ করে বসে থাকে নি। তারা প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এই আক্রমণের প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে মার্কিনিরা। একের পর এক অবিশ্বাস্য সব পরীক্ষণ চালায় মানব জাতির উপর। যার মধ্যে ছিলো ১৯৪৫ সালের ৬ই আগস্ট ও ৯ই আগস্ট জাপানীদের উপর প্রথম নিউক্লিয়ার বোমা লিটলবয় ও ফ্যাটম্যান ব্যবহার। এরূপ আরেকটি পরীক্ষণ ছিলো ফিলাডেলফিয়া এক্সপেরিমেন্ট।
ইউএসএস এল্ড্রিজ, ছবি: Wikimedia
ফিলাডেলফিয়া এক্সপেরিমেন্ট বা ফিলাডেলফিয়া গবেষণা বা ফিলাডেলফিয়া পরীক্ষণ। যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া রাজ্যের ফিলাডেলফিয়া এলাকায় ইউএস নেভির ডেস্ট্রয়ার ইউএসএস এল্ড্রিজ (USS Eldridge DE-173) -এ করা একটি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণ। এটি প্রজেক্ট রেইনবো নামেও পরিচিত। এই পরীক্ষণটির মূল উদ্দেশ্য ছিল শত্রুর চোখে জাহাজকে কীভাবে অদৃশ্য করা যায়। একটি জাহাজকে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিতে শত্রু চোখে অদৃশ্য রেখে একস্থান থেকে অন্যস্থানে স্থানান্তর করার একটি প্রক্রিয়া। যেটি গড়ে উঠেছে আইনস্টাইনের ইউনিফাইড ফিল্ড থিওরি এর উপর ভিত্তি করে।
ইউনিফাইড ফিল্ড থিওরি এমন একটি তত্ত্ব যাতে বলা হয়েছে− যদি কোনস্থানে কোনভাবে আলোকে এমন অবস্থায় বেধে রাখা যায় যে, সেখান থেকে আলো কোনভাবে বের হতে পারবে না আবার সে স্থানে আলো ঢুকতেও পারবে না তাহলে পৃথিবীর সময়কে বেধে ফেলা সম্ভব। এমনটি ওই স্থানে মহাকর্ষ বলও কাজ করবে না। আইনস্টাইন নিজে এই তত্ত্বের প্রবক্তা হলেও তিনি এর সফল ব্যবহারিক কোন প্রমাণ দেখাতে পারেন নি। কিছু গবেষকদের ধারণা এই যে, বড় ইলেকট্রিক্যাল জেনারেটর ব্যবহার করে নির্দিষ্ট বস্তুর চারপাশের আলোকে বেধে ফেলা সম্ভব। আর এতে করেই সাধারণের কাছে অদৃশ্য হয়ে যাবে বস্তুটি। এক্ষেত্রে উঠে আসে বিখ্যাত নিকোলা টেসলা’র নাম।
বস্তুত মার্কিন সেনাবাহিনী এটিকে বেশ গুরুত্ব দিয়েছিল আর এজন্যই এই গল্পের সৃষ্টি।
ফিলাডেলফিয়া পরীক্ষণ আদৌ হয়েছিলো কিনা এ নিয়ে যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন- এই পরীক্ষাটি আমেরিকা সরকার প্রকাশ করেনি কারণ এতে অনেক ক্রুদের প্রাণ হানী হয়েছিলো। এতে সামরিক বাহিনীর মাঝে অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে তাই পরীক্ষণটির ব্যপারে মার্কিন সরকার কোন মন্তব্য করেন নি।
ফিলাডেলফিয়া এক্সপেরিমেন্ট মুভিতে ইউএসএস অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার দৃশ্য। ছবি: hiddencityphila.com
আবার কেউ কেউ মনে করেন- প্রকৃতার্থে ফিলাডেলফিয়া পরীক্ষণটি করাই হয়নি বা হলেও তাতে মার্কিনিরা সফল হতে পারে নি।
যাইহুক, বিভিন্নভাবে পরীক্ষণটির ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এতে টেনে আনা হয়েছে বিখ্যাত সার্ব-আমেরিকান ইনভেন্টর নিকোলা তেসলাকে। তিনি এই কাজটি করার জন্য উচ্চমানের একটি জেনারেটরের সাহায্য নেন। এবং কয়েল দিয়ে জাহাজটিকে জড়িয়ে নেন।
১৯৪৩ সালের ২২শে অক্টোবর। এবার বিজ্ঞানীরা জাহাজে ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরির সিদ্ধান্ত নিলেন। একটি বড় বৈদ্যুতিক জেনারেটর থেকে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ডেস্ট্রয়ার এল্ড্রিজকে কয়েল দিয়ে জড়িয়ে প্রচুর উচ্চ বিভবের বিদ্যুৎ পরিবাহিত করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল জাহাজের চারপাশে প্রচুর শক্তিসম্পন্ন একটি চুম্বকক্ষেত্র তৈরী করা। তবে ফলাফল যেন বাস্তবতাকেও হার মানিয়ে দিচ্ছিল। উচ্চমাত্রার বিভবের ফলে জাহাজের চারপাশে সবুজাভ ধোঁয়া দেখা যায় এবং জাহাজটি প্রায় অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু এই পর্যায়ে তারা ব্যর্থ হয়। এল্ড্রিজ যখন পুনরায় দৃশ্যমান হয় তখন জাহাজে থাকা ক্রুদের মধ্যে বিভিন্ন সমস্যা দেখা যায়, তারা বমিভাব অনুভব করে। কিছু ক্রু মারা যায় বলেও বলা হয়। তখন তেসলা জানায় কিছু ত্রুটি হয়েছিলো তাই এরূপ হয়েছে। এবং নৌবাহিনীর অনুরোধে সরকার পরবর্তী পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করে ১৯৪৩ সালের ২৮ অক্টোবর।
এবাবেই সবুজ ধোঁয়াশায় অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার বর্ণনা দেয়া হয়। ছবি: allthatsinteresting.com
প্রথমবার যন্ত্র সাজানোতে ভুল ছিল বলে জাহাজটি শুধুমাত্র কিছু সময়ের জন্য অদৃশ্য হয়েছিলো। এবার নতুন করে সকল যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম সাজানো হলো। নিকোলা জেনেরেটর স্টার্ট করে বিভবের মাত্রা বাড়াতে থাকলেন। একপর্যায়ে উচ্চমাত্রার বিভব তৈরী হলে জাহাজের চারিপাশে নীল আলোর মত কিছু একটা দেখা যায়। এবং জাহাজটি অদৃশ্য হয়ে যায়। এবার শুধুমাত্র অদৃশ্যই হয়ে যায়নি। টেলিপোর্টের মাধ্যমে ফিলাডেলফিয়া থেকে ২০০ মাইল দূরে ভার্জিনিয়ার নরফোক শিপইয়ার্ডে চলে যায়। এবং পুনরায় ফিলাডেলফিয়াতে ফিরে আসে। জানা যায যে, নরফোকে এসএস আন্ড্রু ফুরুসেইথ নামক জাহাজের সামনে ইউএসএস এলড্রিজ কিছু সময় সম্পূর্ণ দৃশ্যমান ছিল। নরফোকে এলড্রিজকে দেখা যায় মাত্র ১০ সেকেন্ডের জন্য। এরপর এটি পুনরায় যে স্থান থেকে অদৃশ্য হয়েছিল ঠিক সেই স্থানেই ফিরে আসে।
পরীক্ষণটির ফলাফল
ফিলাডেলফিয়া এক্সপেরিমেন্টের ফলাফল ছিলো খুবই ভয়ানক। পরীক্ষণটির পর জাহাজে থাকা অনেক ক্রু মৃত্যুবরণ করে। অনেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। বেশ কিছু ক্রু চিরকালের জন্য অদৃশ্য হয়ে যায়। যাদেরকে আর কখনোই পাওয়া যায় নি। আর কিছু ক্রু অদৃশ্য সব ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যায়। যেমন-
যেকোন বস্তু ভেদ করে চলাফেরার ক্ষমতা লাভ করে। এবং এটিও জানা যায় যে কিছু ক্রু যারা বেঁচে ফিরে এসেছিলেন তাদের ব্রেনওয়াশ করা হয়। ফলে পরীক্ষণ সম্পর্কে তারা কিছুই মনে করতে পারে নি।
ডেকের সাথে অর্ধ-গলিত একজন নাবিক। ফিলাডেলফিয়া মুভির দৃশ্য। ছবি: ব্রিটিশ ম্যাগাজিন express.co.uk থেকে নেয়া
পরীক্ষণটির যৌক্তিকতা
ফিলাডেলফিয়া পরীক্ষণটি মার্কিন সরকার কর্তৃক কখনোই স্বীকার করা হয় নি। সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গিতে একে সম্পূর্ণ ফাপরবাজি এবং অতিপ্রাকৃত একটি ঘটনা বলে মনে করা হয়। অনেকে আবার মনে করেব, কিছু একটা ঘটেছিল সেদিন ফিলাডেলফিয়াতে। কিন্তু বিজ্ঞান বলে, এ ধরনের পরীক্ষণ এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। এমনকি এক্সপেরিমেন্টটিতে আইনস্টানের সম্পৃক্ততারও কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
তাহলে কি পরীক্ষণটি আসলেই গুজব? নাকি এড়িয়ে চলা হচ্ছে মানব সভ্যতার অন্যতম এক নব আবিষ্কারকে! আবার এল্ড্রিজের শিপ লগের তথ্য থেকে জানা যায় ভিন্ন কথা।
যে বিষয়টি মার্কিন সরকার স্বীকার পর্যন্ত করেন নি এমন একটি গুজব এ’কান ও’কান হতে হতে ছড়িয়ে পড়ছে গোটা দেশে। আর ঘটনাটি আরো ভালোভাবে জনসম্মুখে আসে মরিস কে. জেসাপের মাধ্যমে।
মরিস কে. জেসাপ
মরিস কে. জেসাপ ছিলেন একজন মার্কিন গণিতবিদ, জ্যোতিঃপদার্থবিদ, লেখক এবং ভ্রমণকারী। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সট্রাকটর ও বৈজ্ঞানিক গবেষক মরিস কে. জেসাপের ছিলো জ্যোতির্বিজ্ঞান ও প্রত্নতত্ত্ব সহ বেশ কিছু কাজের বিস্তর অভিজ্ঞতা। তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে বেশ আগ্রহী ছিলনে। হঠাৎ ইউএফও (UFO) নিয়ে লেখালেখি শুরু করে দেন। এবং ১৯৫৫ সালে দ্য কেস ফর দ্য ইউএফও নামে একটি বই প্রকাশ করেন। বইটিতে তিনি পদার্থবিদ্যা, মহাকাশ, জ্যোতির্বিদ্যা, আবহাওয়াসহ বিভিন্ন বিজ্ঞান ভিত্তিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। তার আলোচনা থেকে বাদ যায় নি কিছু রহস্যময় বিষয়ও। তিনি বইটিতে আইনস্টাইনের আইনস্টাইনের ইউনিফাইড ফিল্ড থিওরির কথাও উল্লেখ করেন। আর তখনই ঘটনার মোড় পরিবর্তন হয়ে যায়।
মরিস কে. জেসাপ। ছবি: গুগুল (Google)
১৯৫৬ সালের ১৩ জানুয়ারি কার্লোস মিগুয়েল অ্যালেন্ড নামে এক ভদ্রলোক থেকে একটা চিঠি পান মরিস। চিঠিতে ইউনিফাইড ফিল্ড থিওরি নিয়ে কিছু তথ্য দেয়া ছিলো। চিঠিটি ছিলো এরূপ-
১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন তিনি তার জাহাজ এসএস অ্যান্ড্রু ফুরুসেথ ডেস্ট্রয়ার এল্ড্রিজের ওপর পরীক্ষা চালানোর সময় পাশেই নোঙর করা ছিল। ডেস্ট্রয়ারকে পাহারা দেয়ার দায়িত্ব ছিল কার্গো জাহাজটির, যাতে আশেপাশে কেউ ঢুকতে না পারে। পরীক্ষা শুরু হবার পর ঘটল আশ্চর্য ঘটনা। জাহাজের ওপর তৈরী হল একটা বৃত্তাকার চৌম্বকক্ষেত্র। সেই বৃত্তাকার ক্ষেত্রের ভিতর দিয়ে একে একে সব নাবিক ঢুকে যেতে থাকলেন। আর তারপরই জড় পদার্থের জাহাজটি নিমিষেই হাওয়া হয়ে গেল। ঠিক যেন বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর প্রতিচ্ছবি। এভাবেই আরো বেশ কিছু ঘটনা বর্ণনা করেছেন তিনি। আর সবশেষে লিখেছেন ফিরে আসার পর জাহাজের নাবিকদের ভয়াবহ পরিণতির কথা। তার মতে, খুব অল্প নাবিকই বেঁচে আছেন, কিন্তু যারা বেঁচে আছেন তাদের সাথে ঘটে চলে আশ্চর্য রকমের ঘটনা। কেউ কেউ দেয়াল ভেদ করে যেতে পারতেন, কেউবা হঠাৎ উধাও হয়ে যেতেন। একবার দুজন মারা গিয়েছিল হঠাৎ গায়ে আগুন লেগে যাওয়াতে। তাদের আগুন লাগার কোনো কারণ ছিল না, তবুও আগুনে পুড়ে মারা যান তারা। জাহাজটি ঠিকভাবে টেলিপোর্ট করা গেলেও মানুষের বেলায় হাইপার-ফিল্ড বিরূপ প্রভাব ফেলবে তা কেউ ভাবেনি। কিন্তু পরীক্ষা শেষে তা বুঝতে পারার পর আর কিছুই করার ছিল না ইউএস নেভির। আর তাই তারা ঘটনাটি ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করেন।
কার্লোস মিগুয়েল অ্যালেন্ড বা কার্লোস এম. অ্যালেন্ড পেশায় একজন নাবিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি বেশ নাম করেছিলেন। কিছুটা পাগলাটে স্বভাবে কার্লোসের দাবি- তিনি এসএস অ্যান্ড্রু ফুরুসেথ নামের একটি কার্গো জাহাজের নাবিক ছিলেন। ফিলাডেলফিয়ায় ইউএএস এলড্রিজে ইউনিফাইড ফিল্ড থিওরি প্রয়োগ স্বচক্ষে দেখেছিলেন তিনি। এরপর প্রায় ৫০বার তাদের মাঝে চিঠি আদান প্রদান হয়। চিঠিগুলোতে তিনি ফিলাডেলফিয়ার কাহিনীসহ ভয়াবহতার বর্ণানা প্রদান করেন।
কালোর্স এম. এলেন। ছবি: সংগৃহীত
১৯৫৭ সাল হঠাৎ জীবনের মোড় ঘুরে যায় মরিস কে. জেসাপের। ওয়াশিংটনের অফিস অফ নেভাল রিসার্চ থেকে মরিসকে দেখা করার অনুরোধ করা হলে যথা সময়ে সেখানে উপস্থিত হন তিনি। যথারীতি আলাপ আলোচনা শেষে ইউএফও (UFO) বইটির একটি পেপারব্যাক কপি ধরিয়ে দেয়া হয় জেসাপের হাতে। বইটি খুলেই অবাক হন তিনি। কৌতুহলী দৃষ্টিতে অফিসারের দিকে তাকাতেই তিনি বলেন- এই বইটি অফিস অব নেভাল রিসার্চের চিফ এডমিরাল এন. ফার্থের ঠিকানায় পাঠানো হয়েছে। অফিসার তাকে বইটি খুলতে বললে তিনি বইটি খুলেন এবং ফিলাডেলফিয়া অধ্যায়ে দেখেন তিনটি ভিন্ন কালিতে তিনটি মন্তব্য করা রয়েছে। যদিও অফিসার তাকে বলেন যে তিনজন ব্যক্তি মন্তব্যগুলো করেছেন। কিন্তু জেসাপ বুঝতে পারেন যে তিনটি মন্তব্য একই ব্যক্তির তিনি হলেন কার্লোস এম. এলেন্ড।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কার্লোস যে জাহাজে ছিলেন তার ডকুমেন্ট। ছবি: staticflickr
জেসাপ অফিসারকে কার্লোসের চিঠিগুলোর কথা খুলে বললেন। সেদিনের মত আলোচনা সমাপ্ত হলেও জেসাপের জীবনে নেমে এসেছিলো এক কালো অধ্যায়। ১৯৫৮ সালে তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে নিউ ইয়র্কে চলে যান। এতে প্রায় হতাশ হন ৫৮ বছর বয়সী জেসাপ। হতাশা আর বিষন্নতায় ভোগতে থাকেন তিনি।
মরিস কে. জেসাপের আত্মহত্যা: নতুন রহস্যের সৃষ্টি
এরই মধ্যে ১৯৫৯ সালের ২০ এপ্রিল আত্মহত্যা করেন জেসাপ। এটি নিয়ে সৃষ্টি আরেকটি রহস্য। ওয়াশিংটনের অফিস অফ নেভাল রিসার্চে যাওয়া পূর্ব পর্যন্ত ভালোই চলছিলো জেসাপের জীবন। কিন্তু সেখান থেকে ফেরার পর খুব খারাপ সময় পার করতেছিলেন তিনি। হঠাৎ কেনোই বা তার স্ত্রী কোন কারণ ছাড়াই চলে যাবে তাকে ছেড়ে। এর এক বছরের মধ্যে তার আত্মহত্যা। নতুন রহস্যের সৃষ্টি এখানেই।
ফ্লোরিডার ডেড কাউন্টি পার্কে একটি স্টেশন ওয়াগনের মধ্যে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় জেসাপকে। স্টেট পুলিশ অফিসাররা এটিকে আত্মহত্যা বলে ঘোষণা করে। সামনে চলে আসে আত্মহত্যার মোটিভ। স্ত্রী বিয়োগের ফলে বিষন্ন ছিলো মরিস। উল্লেখ্য মরিসের মৃত দেহ পুলিশ খুঁজে পাওয়ার সময় তার গাড়ীর ইঞ্জিন চালু ছিলো।
যে গাড়ীতে আত্মহত্যা করেন মরিস কে. জেসাপ। ছবি: de173
স্টেট পুলিশ জানায়, গাড়ির সব কাঁচ উঠিয়ে, একজস্ট পাইপের নল মুখে দিয়ে সেটির মাথা গাড়িরর ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল। ফলে অতিরিক্ত বিষাক্ত কার্বন মনোঅক্সাইডের প্রভাবেই মৃত্যু হয়। অনেকে তার এই মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে স্বীকার করে নি। কেউ কেউ মনে করেন, ফিলাডেলফিয়ার রহস্য জনসম্মুখে প্রকাশ করার কারণেই তাকে হত্যা করা হয়েছিল। প্রকৃতার্থে, মরিস কে. জেসাপের মৃত্যু রহস্য আজও অজানাই রয়ে গেলো।
এদিকে মরিসের মৃত্যুর পর অদৃশ্য হয়ে যায় কার্লোস এম. এলেন্ড। তাকে আর কোথাও দেখা যায়নি। উইকিপিডিয়ার তথ্যানুসারে, ১৯৯৪ সালে মৃত্যু হয় কার্লোসের।
আপাতদৃষ্টিতে ফিলাডেলফিয়া পরীক্ষণ একটি গুজব বলেই ধারণা করা হয়। কেননা, এটি কেবল বৈজ্ঞানিক যৌক্তিকতা নির্ভর তত্ত্ব মাত্র। অন্যদিকে, মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকেও এধরণের কোন পরীক্ষণ সম্পর্কে কিছু বলা হয় নি। এছাড়া পরীক্ষণটিতে আইনস্টানের কোন সম্পৃক্ততাও খোঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু এর ভয়াবহতার কারণে এটিকে স্বীকার করা হয় নি।
মরিস কে. জেসাপের মৃত্যুর পর একমাত্র কার্লোস এম. এলেন্ডই ছিলো একমাত্র প্রমাণ। কিন্তু সেও নিখোঁজ হয়েছিলো গোটা তিন দশক। অন্যদিকে জেসাপের রহস্যময় জীবনযাত্রা পরিবর্তন ও আত্মহত্যা বিষয়টিকে আরও রহস্যময় করে তোলে।
১৯৯৪ সালে ফরাসি পদার্থবিদ জ্যাকুয়েস এফ. ভ্যালী ফিলাডেলফিয়া এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে জার্নাল অব সায়েন্টিফিক এক্সপ্লোরেশন –এ একটি আর্টিকেল প্রকাশ করেন। তিনি মরিস কে. জেসাপের মতোই একজন জ্যোর্তিবিজ্ঞানী ছিলেন। ইউএও নিয়েও তার প্রবল আগ্রহ ছিলো বলে তাকে ইউএফওবিদও বলা হয়ে থাকে।
জ্যাকুয়েস এফ. ভ্যালী যখন ফিলাডেলফিয়া পরীক্ষণ নিয়ে কাজ করছেন তখন তিনি এবিষয়ে ভালো জানেন এমন এক ব্যক্তির খোঁজ করছিলেন। ১৯৪২-৪৫ ইউএস নেভিতে কর্মরত ছিলেন এডওয়ার্ড ডাডজন নামের এক ব্যক্তি জ্যাকুয়েসকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসেন। তিনি অ্যাং লস্ট্রম নামের জাহাজের টেকনিশিয়ান ছিলেন।
ইউএসএস এলড্রিজে যখন পরীক্ষণটি পরিচালনা করা হয় তখন তিনিও ফিলাডেলফিয়া শিপ ইয়র্ডেই ছিলেন। তার মতে, জাহাজে যে প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছিল তা হল ডিগাসিং নামের একটি প্রযুক্তি এবং এর ফলে জাহাজ রাডারে বা বাস্তবে অদৃশ্য হবে না, কিন্তু সাগরের নিচের সি-মাইন বা ইউ-বোট সাবমেরিনগুলোর ম্যাগনেটিক টর্পেডোতে তা ধরা পড়বে না। আর টেলিপোর্টেশনের ঘটনাটিকে নিছক গুজব বলে জানান তিনি। খুব দ্রুত সম্ভব হলে ইউএস নেভি জাহাজ যাতায়াতের কিছু গোপন খাল ব্যবহার করতে পারতো, যাতে ভার্জিনিয়া যেতে সময় লাগতো ৬ দিনের স্থানে ২ দিন।
১৯৯৯ সালে ইউএসএস এল্ড্রিজের নাবিকদের একটি পুনর্মিলনের অনুষ্ঠানে এক সাংবাদিককে এ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানান তিনি। ডাডজন বলেন-
ফিলাডেলফিয়াতে ইউএসএস এলড্রিজে ইউনিফাইড ফিল্ড থিওরি উপর কোন পরীক্ষণই করা হয় নি। তিনি বলেন, ১৯৪৩ সালের ২৮শে অক্টোবর জাহাজটি ফিলাডেলফিয়াতে ছিলোই না। জাহাজটি সেদিন নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে ছিল। তিনি জাহাজের শিপ লগ প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেন।
যাইহুক, একপক্ষ এটিকে গুজব এবং অপর পক্ষ এটিকে সত্য বলে চালিয়ে দিচ্ছে। সাথে দিচ্ছে নিজস্ব কিছু মতামত। তাদের মতে, জাহাজের মিথ্যা শিপ লগ প্রকাশ করে আসল ঘটনা চাপা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে যেহেতু সরকারে পক্ষ থেকে এবিষয়ে কিছু বলা হয় নি তাই ধরেই নেয়া যায় বিষয়টি আসলেই একটি গুজব। কিছু কল্পনাপ্রসুত বিজ্ঞান প্রেমিক বিষয়টিকে অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপন করেছে। এবং মার্কিন নেভির প্রতি জনগণের অবিশ্বাস সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, এটি ছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিনীদের মাঝে বিরোধ সৃষ্টির অন্যতম এক অস্ত্র। বিষয়টিকে এতটাই অতিরঞ্জিত করা হয় যে, ১৯৮৪ সাল স্টুয়ার্ট রাফিল –এর পরিচালনায় সালে দ্য ফিলাডেলফিয়া এক্সপেরিমেন্ট নামে একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। এবং ১৯৯৩ সালে এর সিকুয়াল দ্য ফিলাডেলফিয়া এক্সপেরিমেন্ট ২ চলচ্চিত্র মুক্তি পায়।
এক্সপেরিমেন্ট অব ফিলাডেলফিয়া চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য। ছবি: military.com
এসব ঘটনার পর মার্কিন সরকার ১৯৫১ সালে জাহাজটিকে গ্রিসের কাছে বিক্রি করে দেয়। যার নতুন নাম দেয়া হয় এইচএস লিয়ন (HS Lion)।
সম্পর্কিত শব্দসমূহঃ
- HS Lion
- UFO
- USS Eldridge
- USS Eldridge DE-173
- অদৃশ্য
- অদৃশ্য ক্ষমতা
- অফিস অফ নেভাল রিসার্চ
- আইনস্টাইন
- ইউএফও
- ইউএফও (UFO)
- ইউএসএস এল্ড্রিজ
- ইউনিফাইড ফিল্ড থিওরি
- এইচএস লিয়ন
- এডমিরাল এন. ফার্থ এডমিরাল
- এসএস আন্ড্রু ফুরুসেইথ
- কার্লোস এম. অ্যালেন্ড
- কার্লোস মিগুয়েল অ্যালেন্ড
- জার্নাল অব সায়েন্টিফিক এক্সপ্লোরেশন
- জ্যাকুয়েস এফ. ভ্যালী
- দ্য কেস ফর দ্য ইউএফও
- দ্য ফিলাডেলফিয়া এক্সপেরিমেন্ট
- নরফোক শিপইয়ার্ড
- নিকোলা টেসলা
- ফিলাডেলফিয়া
- ফিলাডেলফিয়া এক্সপেরিমেন্ট
- ফিলাডেলফিয়া পরীক্ষণ
- ভার্জিনিয়া
- মরিস কে. জেসাপ
- স্টুয়ার্ট রাফিল
- স্টেশন ওয়াগন